রকেটবিজ্ঞানী নাম্বী নারায়ণন এর দেশভক্তির পরিণাম
ইনি সেই নাম্বী নারায়ণন যিনি ভারতীয় মহাকাশ প্রযুক্তিতে বিপ্লব এনেছিলেন। তিনি ভারতে প্রথম তরল জ্বালানীর রকেট প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিলেন। অশেষ দেশভক্তি এবং দেশকে নতুন কিছু উপহার দেওয়ার ইচ্ছা তাঁর কাজে উৎসাহ প্রদান করেছিল। কিন্তু কেন তাকে মিথ্যা অভিযোগে ৫০ দিন যাবত কারাগারে নির্যাতিত হতে হয়?
বাল্য ও শিক্ষা জীবন
এস নাম্বী নারায়ণন তামিলনাড়ুর ( Tamil Nadu ) নাগারকয়েলের বর্তমান কন্যাকুমারীর একটি তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যেখানে তিনি ডিভিডি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তাঁর মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি মাদুরাইর থিয়াগরাজার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্থাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
বিক্রম সারাভাই এর সাথে প্রথম দেখা হয় ১৯৬৬ সালে যখন বিক্রম সারাভাই ইসরোর চেয়ারম্যান ছিলেন। মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের (এসএসটিসি) চেয়ারম্যান, সারাভাই কেবলমাত্র উচ্চ দক্ষ পেশাদারদের নিয়োগ দিচ্ছিলেন। তাই নাম্বী নারায়ণ এমটেক ডিগ্রির জন্য তিরুবনন্তপুরমের কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন । এই কথাটি জানতে পেরে, সারাভাই তাকে আইভী লীগের ( ivy league ) কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের প্রস্তাব দেন। ফলশ্রুতিতে তিনি নাসার ফেলোশিপ এবং ১৯৬৯ সালে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে আবেদন গৃহিত হয়। তিনি সেখানে থেকে রেকর্ড দশ মাসের মধ্যে অধ্যাপক লুইজি ক্রোকোর অধীনে রাসায়নিক রকেট প্রপুলেশনে স্নাতক প্রোগ্রাম শেষ করেন । নাসা থেকে তাকে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয় কিন্তু তাঁর সত্ত্বেও দেশের জন্য কিছু করার আশা নিজ দেশে ফিরে আসেন।
কর্মজীবন
দেশে এসে তিনি ইসরোতে যোগ দেন। তখন ভারতের রকেট প্রযুক্তি ছিল সলিড মোটর কেন্দ্রিক।
১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি ভারতে প্রথম তরল জ্বালানী রকেট প্রযুক্তি চালু করেন, যখন এপিজে আবদুল কালাম ও তাঁর দল সলিড মোটর নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি ইসরোর ভবিষ্যতের বেসামরিক মহাকাশ কর্মসূচির জন্য তরল জ্বালানী ইঞ্জিনগুলির প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে পূর্বে ধারণা দিয়েছিলেন এবং তত্কালীন ইসরো চেয়ারম্যান সতীশ ধাওয়ান এবং তাঁর উত্তরসূরি ইউআর রাউ এর কাছ থেকে উত্সাহ পেয়েছিলেন । নাম্বী নারায়ণন MID-1970s মডেলের ৬০০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি থ্রাস্ট ইঞ্জিন তৈরিতে সফল হন এবং তারপরে বড় ইঞ্জিনগুলিতে অগ্রসর হয়।
প্রায় দুই দশক ধরে কাজ করার পরে, ফরাসি সহায়তায় নারায়ণন ও তাঁর দলটি পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল (পিএসএলভি) সহ বেশ কয়েকটি ইসরোর রকেট দ্বারা ব্যবহৃত বিকাশ ইঞ্জিন তৈরি করেন যা ২০০৮ সালে চন্দ্রায়ণ -১ কে চাঁদে নিয়ে যায়। বিকাশ ইঞ্জিনটি দ্বিতীয়টিতে ব্যবহৃত হয় পিএসএলভির দ্বিতীয় পর্যায় এবং জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেলের (জিএসএলভি) দ্বিতীয় এবং চার স্ট্র্যাপ-অন স্টেজ হিসাবে ।
মিথ্যা অভিযোগ
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, যে লোকটি নিজের দেশের জন্য এতকিছু করেছে তাঁরই বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালে ইসরোর গোপন নথি ফাঁসের মিথ্যা অভিযোগ এনে ৫০ দিন ধরে জেলখানায় বন্ধি করে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল।
গ্রেপ্তার নাম্বী নারায়ণন |
১৯৯৬ সালে, সিবিআই তার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ খারিজ করে দেয়, এবং এর দু'বছর পরে, অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাকে খালাস করে দেয়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে গোয়েন্দা ব্যুরোর হাতে নাম্বির দীর্ঘকাল কষ্টের গল্প রয়েছে। কর্মকর্তারা তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট তাকে নির্দোষ প্রমাণিত করার পরে, নাম্বি কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আবেদন করেছিলেন, যিনি ইসরো-র গোয়েন্দা মামলায় নাম্বিকে ফাঁদে ফেলার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন।
স্বীকৃতি
নাম্বী নারায়ণ তাঁর এই দীর্ঘ কষ্টের কথা ২০১৮ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা বই “ Ready To Fire: How India and I Survived the ISRO Spy Case ” নামের বইে বিস্তারিত তোলে ধরেন। প্রজেশ সেন ২০১৭ সালে " ওর্মকালুদে ভ্রমনপধম: নাম্বী নারায়ণনের একটি আত্মজীবনী ( Ormakalude Bhramanapadham: An Autobiography by Nambi Narayanan) " নামে তাঁর আত্মজীবনী রচনা করেন।
এছাড়াও ২০২০ সালে তাঁর জীবনীর উপর ভিত্তি করে বিখ্যাত বলিউড অভিনেতা আর. মাধবন (R. Madhavan) এর গল্প ও পরিচালনায় রকেট্রি : দি নামবি ইফেক্ট ( Rocketry: The Nambi Effect ) নামে একটি মুভি মুক্তি পায়। তবে যাই হোক, তাঁর কাজের স্বীকৃতি কিন্তু তাঁর দেশ তাকে দিয়েছে। ২০১২ সালে তাকে দেশ সেবার প্রতীক স্বরূপ ভারতের রাষ্ট্রপতির তৃতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান “ পদ্মভূষণ ” প্রদান করা হয়। এমন কি চন্দ্রায়ণ -২ নামের মহাকাশ অভিযান তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয়।
বিচারের দাবি
২০১৩ সালের ৭ই নভেম্বর, নাম্বী নারায়ণ ষড়যন্ত্রের পিছনে থাকা ব্যক্তিদের গোমর ফাঁস করে দেওয়ার জন্য তার মামলা বিচারের দিকে এগিয়ে যান। তিনি বলেন যে তাঁর উপর হওয়া ষড়যন্ত্রের ফলে তরুণরা দেশের কাজে নিরুৎসাহিত হবে।
১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে, সুপ্রিম কোর্ট-এর জাজ গুপ্তচর কেলেঙ্কারিতে প্রাক্তন মহাকাশ বিজ্ঞানী নাম্বী নারায়ণনের কঠোর গ্রেপ্তার এবং অভিযুক্ত নির্যাতনের তদন্তের জন্য তার সাবেক বিচারকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্যানেল নিয়োগ দিয়েছিল যা জাল প্রমাণিত হয়।
প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রার নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ তাকে ৫০ লক্ষ রুপিও প্রদান করেন, যা এত বছর তিনি যে মানসিক নিষ্ঠুরতা ভোগ করেছেন তার জন্য ক্ষতিপূরণ। নাম্বী নারায়ণন তাঁর সম্মান ও ন্যায়বিচারের জন্য বিভিন্ন ফোরামে আইনী লড়াই শুরু করার প্রায় এক চতুর্থাংশের পরে পুনরুদ্ধারটি এসেছে। এছাড়াও কেরালা সরকার তাকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ১.৩ কোটি রুপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।