- Anti Ads Bloker -

ফুটবল খেলার ইতিহাস

ফুটবল, ফুটবল খেলার ইতিহাস, ফুটবল খেলা, ফুটবলের ছবি, ফুটবল খেলার প্রাচীন ছবি

ফুটবল নামক বায়ুপূর্ণ পদগোলক পায়ের আঘাতে খেলার সাধারণ নাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর নাম সকার (Soccar)।

ফুটবল খেলার উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ আছে। বিভিন্ন নামে এই খেলাটি প্রাচীন, মিশর, পারশ্য, ব্যবিলন, গ্রিস চীনে প্রচলিত ছিল। তবে আধুনিক ফুটবলের বিকাশ ঘটেছে ইংল্যান্ডে। মধ্যযুগের শেষের দিকে ইংরেজ ক্রীড়াবিদ জে.সি, থ্রিং এই খেলার প্রথম নিয়ম তৈরি করেন। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০ অব্দের দিকে ফুটবল খেলা প্রথম শুরু করেছিল গ্রিক এবং রোমানরা। প্রাচীন গ্রিক এবং রোমানরা বল দিয়ে বিভিন্ন রকমের খেলা খেলত, তার মধ্যে কিছু কিছু খেলা পা ব্যবহার করে খেলত।


চীনে ফুটবল, ফুটবল খেলা
চীনের শিশুরা cuju খেলা

গ্রিক নাট্যকার  Antiphanes (388–311 BC) এবং Clement of Alexandria (c.150-c.215 AD) তাদের বিভিন্ন লেখায় বল খেলার উল্লেখ করেছেন। এই খেলাটা রাগবি ফুটবল খেলার মত ছিল। এর আকার ছিল বেলুনের মতো। চামড়ার থলের ভিতর বাতাস পূর্ণ করে এই বল তৈরি করা হতো। এই খেলার নাম ছিল Episkyros। রোমান খেলা Harpastum এসেছে এই আদি গ্রিক খেলা থেকে।

রোমান রাজনীতিবিদ Cicero (106–43 BC) -এর মতে এই খেলার সময় একজন মানুষ নাপিতের দোকানে সেভ হওয়ার সময় বলের আঘাতে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু ফিফা প্রাচীন গ্রিক খেলা Episkyros (ἐπίσκυρος) কে ফুটবল খেলার আদিরূপ হিসাবে আগে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক খেলা হিসেবে 蹴鞠 cuju -কে ফিফা প্রথম ফুটবল খেলা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে সামরিক প্রশিক্ষণের সহায়ক অঙ্গ হিসেবে চীনারা খেলতো।

চাইনিজ মিলিটারি গ্রন্থ Zhan Guo Ce (খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে ১ম শতাব্দীর মধ্যে রচিত) ফুটবলের সমার্থক শব্দ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে সামরিক অনুশীলনের বর্ণনায় বলা হয়েছে cuju নাম পাওয়া যায়। উল্লেখ্য cuju মানে গোলকে পদাঘাত (kick ball)।  এই খেলায় একটি চামড়ার বলে পা দিয়ে লাথি মারা হত। এই খেলায় সিল্কের কাপড় দিয়ে ছোট বর্তনী তৈরি করে মাটি থেকে ৯ মিটার উপরে বাঁশের  সাথে সংযুক্ত করে রাখা হতো। চীনের হ্যান সাম্রাজ্যের (২০৬-২২০ খ্রিষ্টাব্দ) চীনে cuju  খেলার নিয়ম কানুন প্রতিষ্ঠিত হয়।

জাপানে ফুটবল খেলা, ফুটবল খেলা
জাপানের  কেমারি খেলা

কালক্রমে এই খেলা কোরিয়া এবং জাপানে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে। জাপানে এই খেলার নাম কেমারি ((蹴鞠 kemari)। কেমারি খেলার নিয়ম ছিল কয়েক জন মানুষ একটা বৃত্তাকার মাঠের ভিতর বল লাথি দিয়ে খেলবে তবে তারা চেষ্টা করত বল যেন মাটিতে না পড়ে। কোরিয়াতে এর নাম chuk-guk।

কোনোভাবে গ্রিনল্যান্ডের আদিবাসীদের ভিতর ফুটবল জাতীয় খেলা প্রচলিত ছিল। ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ অনুসন্ধানকারী John Davis গ্রিনল্যান্ডের Inuit দের সাথে ফুটবল খেলার কথা বলেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় লাথি মেরে বল খেলতো অস্ট্রেলীয় আদিবাসীরা অনেক আগে থেকে। নিউজিল্যান্ডে Māori দের ভিতরে এই খেলার নাম ছিল Ki-o-rahi। এই খেলার নিয়ম ছিল একটা বৃত্তাকার মাঠকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগে একটা করে দল থাকত এবং প্রত্যেক দলে ৭ জন করে খেলোয়াড় থাকত এবং মাঠের মাঝখানে একটা বৃত্তাকার সীমানা থাকত। এই খেলায় একটি হলো একদল বল দিয়ে আরেক দলের সীমানা পার করে দিতে পারলে এবং মাঝের বৃত্তটা স্পর্শ করতে পারলে ১ বা ২ নম্বর পেতো।

আধুনিক ফুটবলের আদিরূপ সৃষ্টি হয়েছে ইংল্যান্ডে। খ্রষ্টীয় ৯ম শতাব্দীতে লিখিত Historia Brittonum বইতে এই খেলার উল্লেখ পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডে প্রথম দিকে যে বল খেলা হত তার নাম ছিল 'mob football'। এই খেলায় দুই দলে অগণিত খেলোয়াড় থাকত এবং এরা একটা বলকে গায়ের জোরে ধাক্কা ধাক্কি করে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যেতে পারলে পয়েন্ট হত। এই খেলা তখন প্রতিবেশী গ্রাম বা শহরগুলোর মধ্যে হতো। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই খেলা একটি অন্যতম অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতো। 

John McCrocan নামক জনৈক লেখকের বর্ণনায় পাওয়া যায়, আয়ারল্যান্ডে ১৩০৮ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত একটি ফুটবল খেলার তিনি দর্শক ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে যে বল খেলা হত তার নাম ছিল "calcio storico"। অনেকে মনে করেন, এই খেলাই আধুনিক ফুটবলের প্রাথমিক রূপ ছিল। এই খেলায় সর্বোচ্চ ২৭ জন খেলোয়াড় থাকত। তবে কখনো কখনো এই সংখ্যা ১৫ বা ২০ জন নিয়ে দল গঠিত হতো। এর ভিতরে গোলরক্ষক থাকত ৫ জন।

১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বিশিষ্ট ফুটবল খেলোয়াড়রা কেম্ব্রিজে মিলিত হয়ে এই খেলার আগের আইন-কানুনের পরিবর্তন করে নতুন বিধি তৈরি করেন। কিন্তু তখনো খেলোয়াড়দের সংখ্যার বিষয়ে বিশেষ বিধি নির্ধারিত হয় নি। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে আইন করা হয় যে প্রত্যেক দলে গোলরক্ষক-সহ ১১ জন করে খেলোয়াড় থাকবে তাই ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই আধুনিক ফুটবলের যাত্রা শুরু হয় বলা যায়। এই আইন অনুসারে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই মার্চ ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডের মধ্যে খেলা হয়।

 ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে নতুন নিয়মে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যে। এটি ছিল ফিফা স্বীকৃত প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলা। খেলার ফলাফল ছিল ০-০।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম গোলের পার্শ্ব খুঁটির উপরে আড়া ব্যবহার শুরু হয়।

১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম ফুটবল খেলার মাঠের দৈর্ঘ্য ৯০ মিনিট নির্ধারণ করা হয়।

১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম গোলপোস্টে জাল ব্যবহার করা হয়।

১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম পেলান্টি কিকের আবির্ভাব হয়।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে অলিম্পিকে প্রদর্শনী খেলা হিসেবে ফুটবল প্রতিযোগিতা রাখা হয়। তবে এর জন্য কোনো পুরস্কার বরাদ্দ ছিল না।

১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মে আন্তর্জাতিক ফুটবল ফেডারেশন গঠিত হয়। এর মূল ফরাসি নাম Federation Internationale de Football Association। সংক্ষেপে FIFA(ফিফা)। এই বৎসরেও অলিম্পিকে প্রদর্শনী খেলা হিসেবে ফুটবল প্রতিযোগিতা রাখা হয়। এবং কোনো পুরস্কার বরাদ্দ ছিল না।

১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের অলিম্পিকে পুরস্কারহীন শর্তেই ফুটবল অলিম্পিকে রাখা হয়েছিল। এবং কোনো পুরস্কার বরাদ্দ ছিল না। এই বৎসরে ফিফা সুইজারল্যান্ডে অলিম্পিকের আদল থেকে বেরিয়ে এসে একটি ভিন্নতর আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।

১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের অলিম্পিকে ফুটবল প্রথম আনুষ্ঠানিক খেলার মর্যাদা পায়। এই প্রতিযোগিতা ছিল অপেশাদার খেলোয়াড়দের জন্য। এই অলিম্পিকেই  ইংল্যান্ড জাতীয় অপেশাদার ফুটবল দল অংশগ্রহণ করে জয়লাভ করে।

১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তুরিনে স্যার থমাস লিপটন নিজের নামে একটি ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করফেছিল বিভিন্ন ফুটবল ক্লাব। তবে এই ক্লাবগুলো ছিল বিভিন্ন দেশের। তাই এই প্রতিযোগিতাকেই অনেকে প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই খেলায় পশ্চিম অকল্যান্ড জয়ী হয়েছিল।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে 'স্যার থমাস লিপটন' প্রতিযোগিতায় পশ্চিম অকল্যান্ড জয়ী হয় এবং খেলার নিয়ম অনুসারে এরা চিরকালের জন্য ট্রফি নিয়ে যায়।

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের অলিম্পিকে  ইংল্যান্ড জাতীয় অপেশাদার ফুটবল দল অংশগ্রহণ করে জয়লাভ করে।১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ফিফা অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অনুষ্ঠিত ফুটবল প্রতিযোগিতাকে "অপেশাদার বিশ্ব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ" হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয় এবং এই প্রতিযোগিতা পরিচালনার দায়িত্ব নেয়।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্ম অলিম্পিকে বিশ্বের প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেয় মিশর ও তেরটি ইউরোপীয়ান দল। এতে বেলজিয়াম স্বর্ণ পদক লাভ করে।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে উরুগুয়ে অলিম্পিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ লাভ করে।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ফুটবলে প্রথম বুট ব্যবহার করা হয়।

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে উরুগুয়ে অলিম্পিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয়বার স্বর্ণ লাভ করে। এই বৎসরে ফিফা অলিম্পিকের বাইরে আলাদাভাবে নিজস্ব আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম আর্সেনালের পরিচালক পর্ষদ খেলোয়াড়দের সহজে চেনার জন্য, খেলোয়াড়ের গায়ের পোশাকে নাম্বর বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তখন স্বাগতিক দলের জার্সি নাম্বর থাকত ১-১১ পর্যন্ত এবং সফরকারী দলের নাম্বর থাকত ১২-২২ পর্যন্ত। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে সিদ্ধান্ত হয় যে একই নাম্বার বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রাও নিতে পারবে কিন্তু নম্বর ঐ ১-২২ পর্যন্ত থাকতে হবে। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম জার্সিতে খেলোয়াড়ের নাম লেখা হয় এবং যেকোন নম্বর খেলোয়াড় নিতে পারবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হিসেবে উরুগুয়েকে নির্বাচন করা হয়। প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল ১৩ই জুলাই। এই প্রতিযোগিতায় উরুগুয়ে বিজয়ী হয়। ফ্রান্সের Lucien Laurent বিশ্বকাপে সর্বপ্রথম গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করেন মেক্সিকোর বিপক্ষে।

 ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে লস এঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্ম অলিম্পিকে ফুটবলকে না রাখার পরিকল্পনা করা হয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে তখন ফুটবল (সকার) জনপ্রিয় ছিল না। ফুটবলের পরিবর্তে সেখানে আমেরিকান ফুটবল (রাগবি ফুটবল) জনপ্রিয় ছিল। ফিফা এবং আইওসির মাঝে অপেশাদার খেলার মর্যাদা নিয়ে মতবিরোধও দেখা দেয়। ফলে ফুটবল অলিম্পিক থেকে বাদ পড়ে যায়।

 ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়ান গেমস-এ অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বকাপ প্রথম টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। বর্তমানে এটি টেলিভিশনে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এমনকি অলিম্পিক গেমসের চেয়েও বেশি মানুষ বিশ্বকাপ দেখে থাকে।

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপের একটি নিজস্ব মাস্কট বা প্রতীক রাখা হয়। বিশ্বকাপ উইলি প্রথম বিশ্বকাপ মাস্কট হিসেবে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্বকাপে ব্যবহৃত হয়েছে।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে ফুটবল ফেডারেশন গঠিত হয়।

সূত্র- Onushilon.org